বাগানের দিক থেকে ধুপ করে একটা আওয়াজ এলো। সাথে সাথে মুরগির খোপে একসাথে ডেকে উঠল কয়েকটা মুরগি।
“বেজীটা আবার এসেছে! একবার খেয়ে লোভ হয়ে গেছে। দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা…”
গজ গজ করতে করতে ভেতর ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো এক সুশ্রী তরুণী। ইদানিং রাতের আঁধার নেমে এলেই শুরু হয় বেজীর উৎপাত। গতরাতেও এসেছিল। ওরা মুরগির ডাকাডাকি শুনে ছুটে বেরিয়ে আসতে আসতেই দুষ্ট বেজীটা একটা ডিমপাড়া মুরগী নিয়ে গায়েব! মেয়েটা ভেবেছিল আজও বোধ হয় বেজী এসেছে।
বেজীর পরিবর্তে বাগানের আলোআঁধারিতে চোখাচোখি হয়ে গেল লোকটার সাথে। হ্যাঙলাপাতলা শ্যামলা বর্ণের যুবক। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মোটা ভ্রূ আর নাকের নিচে পুরু গোঁফ। কেমন মাস্তান মাস্তান চেহারা! মেয়েটা চিৎকার দিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, লোকটা ইশারায় থামতে বলল। ঠিক তখনি দেয়ালের ওপাশে দুজন লোকের ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ শোনা গেল।
“কী হয়েছে রে মা…?”
রান্নাঘর থেকে মাঝবয়সী এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। মেয়েটা আঙুল উঁচিয়ে লোকটাকে দেখালো। মাটিতে কাত হয়ে পড়ে ছিল, ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে আবার বসে পড়ল। পা নির্ঘাৎ ভেঙেছে!
“কে তুমি বাবা? কী হয়েছে তোমার?”
লোকটা ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। হাতে পায়ে চোট পেয়েছে। কোনো কারণে ভীতসন্ত্রস্ত। মা মেয়ে ধরাধরি করে বাইরের ঘরে নিয়ে গেল তাকে। বাল্বের আলোয় দেখা যাচ্ছে ওর মুখে আঘাতের চিহ্ন, ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছে। বাম হাতের তালুও কেটেছে বাগানো হেলানো একটা জংধরা টিনে লেগে। গায়ে জ্বর।
“সে কি! তুমি তো ভারি অসুস্থ! মা, যা তো, তোর ডাক্তার কাকুকে ডেকে নিয়ে আয়…”
বাইরে শীত শীত ভাব। মেয়েটা একটা শাল কোনোমতে গায়ে জড়িয়ে একছুটে বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো ছোটখাট শরীরের ভারী চশমা পরা এক লোককে নিয়ে। হাতে একটা ডক্টরস কেস।
পা ভাঙে নি, তবে মচকে গেছে। ডাক্তারবাবু পা-টা প্লাস্টারে মুড়ে কাটা জায়গাগুলোয় ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলেন। হাতের তালুর কাটা জায়গাটায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়ে একটা টিটেনাস ইঞ্জেকশন পুশ করলেন। আর জ্বর-ব্যথার জন্যে দিলেন কিছু ট্যাবলেট।
“আঘাত পেলে কীভাবে? মনে হচ্ছে মারামারি করেছ!”
ডাক্তারবাবুর জিজ্ঞাসার জবাবে লোকটা যা জানাল তার সারমর্ম হচ্ছে- অফিস থেকে ফেরার পথে দুজন ছিনতাইকারীর খপ্পরে পরেছিল সে। সবকিছু কেড়ে নিতে মারধর শুরু করলে সে দৌঁড়ে পালায়। ওদের থেকে বাঁচতে এই গলিতে ঢুকে পড়েছিল। দেয়াল টপকে এপাশে বাগানে নামতে গিয়ে বেমক্কা পা উলটে যায়। সব শুনে ডাক্তারবাবু সমবেদনা জানালেন।
“আর বলো না, এলাকাটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে এসব চোর বাটপার ছিনতাইকারীদের জন্যে। আমাদের রাতুলও তো ওই ছিনতাইকারীদের কারণেই…. আচ্ছা বৌদি, রাতুলের কী অবস্থা এখন?”
“জ্বি কাকা, ওই আগের মতোই! যতক্ষণ ঘুমায় ততক্ষণই ভালো থাকে। জেগে থাকলে যন্ত্রণায় কাতরায়।“
মায়ের হয়ে বলল মেয়ে। মা থেকে থেকে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছছেন।
“আহ, কেঁদো না তো মা! রাতুল ঠিক হয়ে যাবে, ওর কিচ্ছু হবে না… আসেন কাকু আপনাকে এগিয়ে দেই…”
মেয়েটা ডাক্তারবাবুকে এগিয়ে দিয়ে এলো। মা ততক্ষণে রান্নাঘরের কাজ শেষ করেছেন।
“কী নাম তোমার বাবা?”
“জ্বি সূর্য…”
“সূর্য! জানেন, আমার দাদার নামও ছিল সূর্য…!”
অন্যের কথা কেড়ে নেয়ার স্বভাব আছে মেয়েটার। তবে মন্দ লাগে না। খুব আপন আপন লাগে। দু’ঘন্টার আলাপ, অথচ কথার ধরণে মনে হয় কতদিনের পরিচয়! মা হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে গেলেন
“তোমার দাদা বেঁচে নেই বুঝি!”
“জানি নাহ্!”
কেন?
“সে অনেক লম্বা কাহিনী…”
“নীলা মা, আর গল্প করিস না। রাত কত হলো দেখেছিস! খাবার খেতে হবে না?”
“নীলা…!”
“ওহ! আমার নাম… নীলাঞ্জনা! আপনি হাত ধুয়ে আসেন, মা খাবার বাড়ছেন…”
"আপনারা কষ্ট করবেন না, আমি এখন যাই..."
"সেকি, তুমি যে ভীষণ অসুস্থ! খেয়েদেয়ে আজ রাতটা বিশ্রাম নিয়ে সকালে যেও..."
সূর্যের আসলেই কাহিল অবস্থা। গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। ভাঙা হাত-পা নিয়ে এত রাতে যাবেই বা কোথায়? তবে এসব কারণে না, সূর্য থেকে গেল অন্য একটা কারণে। নীলাঞ্জনা নামটার মধ্যে সে এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করছে। এই নীলাঞ্জনা খুব আপন, হৃদয়ের খুব কাছাকাছি থাকা কেউ। কেমন একটা আচ্ছন্ন অনুভূতি। খেতে বসে আড়চোখে মেয়েটাকে কয়েকবার দেখল। খুব আপন লাগছে মেয়েটাকে।
খেতে খেতে জানা গেল রাতুল নীলাঞ্জনার ছোট ভাই। কিছুদিন আগে এক্সিডেন্ট করে শরীরের ডানপাশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করালে ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সেজন্যে অনেক টাকা দরকার। কোথায় পাবে অত টাকা? পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটা ঘরে পরা; সংসার চালানোই দায়, চিকিৎসার খরচ আসবে কোত্থেকে?
মা-মেয়ের কথা শুনতে শুনতে সূর্য খাওয়া শেষ করল। হাত ধুতে কলপাড়ে যেতে যেতে চোখ পড়ল পুজোর ঘরের দেয়ালে। সেখানে ঝুলছে একজন বয়স্ক মানুষের ফ্রেমবন্দি ছবি। তাতে ফুলের মালা। মালার ফুল শুকিয়ে গেছে।
“আমার বাবা!”
পাশ থেকে নীলা বলল। ও কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সূর্য তা খেয়ালই করে নি।
"মারা গেছে...!"
"হুম..." (নীলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল)
“কবে?”
“তাও পাঁচ বছর হতে চলল…”
“নীলা! দেখ তো, রাতুল মনে হয় জেগেছে…”
রাতুল এখনো জোরে কথা বলতে পারে না। তাই মা-মেয়ে সারাক্ষণ একটু তটস্থই থাকে রাতুল ডাকছে কিনা। দুজনই এতে বেশ ধাতস্থ হয়ে গেছে, রাতুলের মৃদু ডাকও তারা বুঝতে পারে।
নীলা তড়িঘড়ি রাতুলের ঘরে গিয়ে লাইট জ্বালালো। সূর্য ওর পিছুপিছু এসেছিল। রাতুলকে তুলে বালিশে হেলান দিয়ে বসাতে নীলাকে সাহায্য করলো ও। মাত্র এই ক’দিনেই রাতুলের বয়স যেন অনেকখানি বেড়ে গেছে। ক্লিনশেভড মুখের জায়গায় খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। ওর মুখের ভালো করে তাকাতেই সূর্য একটুখানি চমকালো- মুখটা কেমন চেনা চেনা লাগছে! কোথায় যেন দেখেছে কয়েকদিন আগে… পত্রিকায়? পরিষ্কার মনে পড়ছে না।
“এখন কেমন লাগছে রাতুল?”
রাতুল মুখে কিছু বলল না। চেহারায় যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। বোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো ওর
“আহা, কাঁদে না ভাই! আমি তো আছি...”
ভাইয়ের মাথাটা বুকে জড়িয়ে নিতে নিতে আড়ালে হাতের তালুতে ভেজা চোখজোড়া মুছল নীলা। ঘরময় অব্যক্ত যন্ত্রণার আবহ। সূর্য কী করবে বুঝতে পারছে না।
“কিরে, রাতুল জেগেছে? ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে তো...”
মা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন। রাতুলের ঘরে সূর্যকে দেখে তিনি একটু অপ্রস্তুত বোধ করলেন।
“একী, বাবা তুমি এখানে? আমি তো ভাবলাম তুমি এতক্ষণে বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছ! নীলা, ওকে শোবার ঘরটা দেখিয়ে দিস নি?”
“আপনি আসুন আমার সাথে। ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ুন। যা ধকল গেল সারাদিন!”
বারান্দার পাশটায় টিন দিয়ে ঘিরে ঘরমত বানানো হয়েছে। ছোট্ট ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটা ছোট খাট আর টেবিল-চেয়ার। তবে সাজানো গোছানো ছিমছাম। সম্ভবত মেয়েটার রিডিং কাম বেডরুম, ঘরটা আজ অতিথিকে ছেড়ে দিয়ে নিজে মায়ের সাথে শোবে।
“এই ঘরটা রাতুলের। এক্সিডেন্টের পর ওকে ভেতরের ঘরে শিফট করা হয়েছে। সেইফটির জন্য।“
“নীলা! একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবে না তো?”
“কী কথা?”
“উনি কি তোমার আপন মা?”
“কেন বলুন তো?”
“না, আসলে তোমার সাথে চেহারা ঠিক মেলে না তো… স্যরি জিজ্ঞেস করলাম…”
“না না অসুবিধা নাই। অনেকেই বলে মার সাথে আমার চেহারা মেলে না। মেলার কথাও না; উনি আমার সৎমা! কিন্তু আপন মা বলতে আলাদা কিছু আছে কিনা তা উনি কোনদিনই আমাকে বুঝতে দেন নি। রাতুলকেও কোনদিন আমার সৎ ভাই মনে হয় নি।“
“রাতুল এক্সিডেন্ট করল কীভাবে?”
“আসলে কী হয়েছিল তা রাতুলই বলতে পারত, কিন্তু সেদিনকার স্মৃতি ওর মনে নেই। ঘটনার সময় আশপাশে যারা ছিল তারা বলেছে ওটা নাকি ঠিক এক্সিডেন্ট ছিল না! রাতুল খুব সাবধানে বাইক চালাত। অফিসে বাইকেই যেত-আসত, কোনদিনও ওকে নিয়ে আমাদের টেনশন করতে হয় নি।
দুর্ঘটনার দিন ও বাইকে করে বাড়ি ফিরছিল। বটতলার মোড়ে আরেকটা বাইক থেকে কে জানি ওর হাতব্যাগটা ধরে টান দেয়। বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচে পড়ে গেছিল। পেছনে ছিল একটা ট্রাক… ভাইটা জানে বেঁচে গেছে, কিন্তু… এতগুলো দিন ও বিছানায় পঙ্গু হয়ে… ওর এত কষ্ট আর সইতে পারছি না…”
নীলার চোখে জলে ভরে গেল। মা এক গ্লাস দুধ নিয়ে এঘরে এসেছেন খানিক আগে। গ্লাসটা টেবিলে রেখে নীলার পাশে বসলেন। নীলা কান্না চাপতে চাপতে নিজের ঘরে চলে গেল। মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন
“মেয়েটা ওর ভাইকে খুব ভালবাসে। একহাতে ভাইয়ের দেখাশোনা করছে। জানো বাবা, রাতুলের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে একটা টান। সেই সাথে আমাদেরও… নীলাকে ছেলেপক্ষ কয়েকদিন আগে দেখে গেছে। ওকে খুব পছন্দ করেছে ওরা। কথা ছিল ভালো একটা দিনক্ষণ দেখে মেয়ে তুলে নেবে।
আমার কত স্বপ্ন ছিল! নীলার বিয়ের পর রাতুলের জন্যে ঘরে একটা বৌ আনব… আমার সব স্বপ্ন নষ্ট করে দিয়েছে ছোট্ট একটা টান… আচ্ছা বল তো বাবা, এরা কি মানুষ?”
সূর্য মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না ও।
“এরা মানুষ না! এরা জানোয়ার…”
বলতে বলতে মা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। এভাবে অচেনা অজানা একজন মানুষের সামনে আবেগপ্রবণ হয়ে একটু অপ্রস্তুত বোধ করছেন তিনি।
“আচ্ছা বাবা, অনেক রাত হলো, এবার তুমি ঘুমাও…”
ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে মা চলে গেল। রাতটা কেটে গেল নিমেষে।
প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই ঘুম ভাঙে মা-মেয়ের। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। ঘরদোর গুছিয়ে মা ঢুকলেন রান্নাঘরে। একটু পরে মেয়েকে এক কাপ চা ধরিয়ে দিলেন সূর্যকে দিতে। নীলা চায়ের কাপ নিয়ে ওঘরের দরজার কয়েকবার নক করল। কিন্তু ভেতরে কোনো সাড়াশব্দ নেই। একহাতে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখল ঘর ফাঁকা। সূর্য কোন ফাঁকে বেরিয়ে গেছে তা ওরা টেরই পায় নি। নীলাঞ্জনা অবাক হলো। টেবিলে চায়ের কাপ রেখে বিছানায় এসে দেখল বালিশের পাশে একটা ভাঁজ করা কাগজ একটা রুবিক্স কিউব দিয়ে চাপা দেয়া। চিঠি! নীলা চিঠির ভাঁজ খুলে জানালার কপাট মেলে দিল। চিঠিটা ওকেই লেখা!
“নীলা!
অনেক কথা বলার ছিল, কিন্তু সাহসে কুলালো না! নীলা নামে আমার একটা ছোট বোন ছিল, শেষ যখন দেখেছি তখন ওর বয়স পাঁচ। জীবনে বহুবার চেয়েছি, বহুভাবে চেষ্টা করেছি ওকে আবার দেখব। কিন্তু কাল রাতের পর আমি চাই কোনোদিনই যেন আমাদের দেখা না হয়। কেন চাই তা বলতে পারছি না। রুবিক্স কিউবটার ভেতর একটা হীরার টুকরো আছে। নিচে একটা ঠিকানা দিলাম, হীরাটা ওখানে বেঁচলে ভালো দাম পাবে। রাতুলের চিকিৎসার জন্যে যত টাকা লাগবে তা এ-থেকেই হয়ে যাবে। স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি রাতুল সুস্থ হয়ে উঠুক। অবশ্য তিনি আমার প্রার্থনা শুনবেন কিনা তা জানি না...
ভাবছ কেন তোমাকে এটা দিচ্ছি? দিচ্ছি এই আশায় যে, আমি আমার বোনের সাথে যে অন্যায় করেছি এই ছোট্ট উপকারটুকু দিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত হবে। গত রাতটা আমাকে আমূল বদলে দিয়েছে। আফসোস! এই রাতটা যদি কুড়ি বছর আগেই আসত…
তোমাদের এই শহরে এসেছিলাম পালিয়ে বাঁচতে। আজ বুঝলাম সবার থেকে পালিয়ে বাঁচা গেলেও নিজের থেকে বাঁচা যায় না। অতীত কাউকেই পালিয়ে বাঁচতে দেয় না...
অনেক অনেক দূরে চলে যাচ্ছি- এত দূরে যে কখনোই আর দেখা হবে না। তবু জেনো দূর থেকে শুভকামনা করছি।
ভালো থেকো, নীল…”
আধভেজা চিঠিটা পড়তে পড়তে নীলার গাল বেয়ে নেমে এলো অশ্রুধারা। অস্ফুটে বেরিয়ে এলো একটিমাত্র শব্দ- দাদা!
নীলাঞ্জনা কারো কাছে নীলা, কারো কাছে নীলু। কিন্তু নীল শুধু একজনের কাছে- দাদা! সূর্য দা। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে যে তাকে ছেড়ে গেছে।
সূর্য আর নীলার মা যখন মারা যায় তখন সূর্যের বয়স দশ। বাবা একা হাতে দুটো শিশুকে সামলাবে কীভাবে? বাবা-মায়ের অবর্তমানে কাকা পিসিরা এক প্রকার জোর করেই সূর্যের বাবাকে বিয়ে করিয়ে দেয়। কমলা দেবীকে নিয়ে সূর্যের বাবা যখন ঘরে এলো তখন সূর্য নেই। এ বাড়ি ও বাড়ি, এ পাড়া ও পাড়া কোথাও তাকে আর পাওয়া যায় নি।
ঘর ছেড়ে শহরে এসে সাত ঘাটের জল খেয়ে সূর্য শেষমেশ পড়ল এক দুষ্ট লোকের হাতে। তার দীক্ষায় সে কিশোর বয়সেই হাত পাকিয়ে ফেলল চুরি ছিনতাই পকেটমারিতে। ঘরে ফেরার তাগিদ সে কখনো অনুভব করে নি; বাবার প্রতি অভিমান সময়ের সাথে সাথে পরিণত হয়েছে জমাটবাধা ঘৃণায়। কিন্তু ছোট্ট বোনটাকে সে কখনো ভোলে নি। কত রাত সে অঝরে কেঁদেছে বোনের কথা ভেবে। ঘর ছাড়ার এক যুগ পরে সে বাড়ি গেছিল বোনকে দেখবে বলে। কিন্তু দেখা হয় নি। বহু বছর আগেই তারা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। বহুভাবে ওদের ঠিকানা বের করার চেষ্টা করেছে এতদিন, পারে নি। কিন্তু বিধাতা যে এভাবে বোনকে মিলিয়ে দেবে তা কে জানত!
সৎমা মানে খারাপ মানুষ- এমনটাই সূর্য সবসময়ই জেনে এসেছে। কিন্তু বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী বলে যাকে সে আজ দেখল সে কেমন সৎমা! নীলাঞ্জনা থেকে তো তাকে আলাদা করা যায় না।
সব অন্যায় অপরাধ অপকর্মের দুনিয়াকে পেছনে ফেলে ঘরে ফেরার আনন্দে যখন সূর্য ব্যাকুল তখনই সে জানল এমন একটা বিষয় যা তার ভাবনার জগতকে উল্টেপাল্টে দিল, দুমড়েমুচড়ে দিল তার ভেতরটাকে।
রাতুলকে দেখে যে সন্দেহ সূর্যের হয়েছিল, নীলার কথায় সেটাই সত্যি প্রমাণ হলো। যে মানুষরূপী জানোয়ার এদের সাজানো সংসারটাকে তছনছ করে দিয়েছে সে যে আর কেউ নয়, সে সূর্য! সবকিছুর মূলে আছে তার একটা হ্যাঁচকা টান...
দুর্ঘটনার দিন রাতুল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাড়ি ফিরছিল। বাড়িতে কিছু কাজ করানোর ছিল, টাকা তোলা সেজন্যেই। টাকাটা রাখা ছিল বাইকের হ্যান্ডেলে ঝোলানো একটা হাতব্যাগে। ও ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি ব্যাংক থেকে কে বা কারা ওকে ফলো করছে। সূর্য আর ওর সহযোগী। রাতুলের পেছন পেছন আসতে আসতে ওরা অপেক্ষায় ছিল শুনশান নীরব একটা জায়গার। বটতলার মোড়ে আসতেই সুযোগ বুঝে ব্যাগটা ধরে টান দেয় সূর্য। ব্যাগ খোয়া না গেলেও বাইকটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যায়। বাইকসহ রাতুল চলে যায় ট্রাকের নিচে।
সবকিছু এখন সূর্যের কাছে পরিষ্কার! নিয়তি বুঝি ওকে বোনের কাছে আর ফিরতে দেবে না!
কী করে ফিরবে সে এই সংসারে? এখানে যে তার জন্যে ঘৃণা ছাড়া কিছু নেই! আদরের বোনটির কাছে ঘৃণার পাত্র হওয়ার চাইতে শ্রেয় সারাজীবন তার কাছে হারিয়ে ফেলা সূর্যদা হয়ে থাকা।
এতটা কাল পুলিশ তার পেছন পেছন দৌঁড়েছে। এবার সূর্য নিজে ধরা দিল নিজের সব দায় স্বীকার করে। আইন তাকে যে শাস্তি দেবে তা-ই তার প্রায়শ্চিত্ত। সব সাজা ভোগের পরও যদি সে আরো কিছু সময় পায় তাহলে না হয় জীবনকে দেবে দ্বিতীয় সুযোগ।
হয়ত সেই দ্বিতীয় জীবনটায় সে বোনের আদরমাখা হাতটা আরেকটিবার ধরে দেখার সুযোগ পাবে!
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
বাগানের দিক থেকে ধুপ করে একটা আওয়াজ এলো।
২৫ নভেম্বর - ২০২৩
গল্প/কবিতা:
৭ টি
সমন্বিত স্কোর
৪.৪২
বিচারক স্কোরঃ ২.২২ / ৭.০
পাঠক স্কোরঃ ২.২ / ৩.০
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪